

ঘুম আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীরকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম দেওয়ার একমাত্র উপায়। আর এই ঘুমের কারণেই আমরা সারাদিন কর্মক্ষম থাকতে পারি। তাই আমরা বলতে পারি যে, বাঁচার জন্য আমাদের ঘুমের অনেক প্রয়োজন আর ঘুম হচ্ছে সঠিকভাবে বাঁচার অন্যতম উপায়।
কিন্তু যাদের অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া (Insomnia) সমস্যা রয়েছে, তারাই জানে যে ঘুমের প্রকৃত মূল্য। অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া হচ্ছে ‘না ঘুমানো’। কিন্তু একদমই না ঘুমিয়ে বেঁচে থাকা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকেই আছে যারা: রাতের পর রাত শুয়ে জেগে থাকে, ঘুমানোর চেষ্টা করলেও তাদের ঘুম আসে না বা ঘুমানোর পর মধ্যরাতে জেগে যায়। তবে, আমরা অনেকেই এটাকে খুব সাধারণ ব্যাপার হিসেবে দেখি বা এটার প্রতি কোন গুরুত্ব দেই না। এই ঘুমজনিত সমস্যা প্রতিনিয়ত চলতে থাকলে এক পর্যায় ক্রনিক (Chronic) হয়ে গিয়ে পরে সেটা অসুখে পরিণত হয় আর ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় ইনসমনিয়া (Insomnia)।


একজন স্বাভাবিক এবং সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিনের ঘুমের মাত্রা
একজন স্বাভাবিক এবং সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন প্রয়োজন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো। সাধারণত, পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘন্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘন্টা, একেবারে ছোট বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা বেশি থাকলে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টার মতো ঘুমানো উচিত। ঘুমের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়, মন সতেজ থাকে আবার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ঘুমানোর সময় শরীরের কোষগুলো বিশ্রাম পায় এবং সেই সঙ্গে শরীর থেকে টক্সিন (toxin) নামক পদার্থ বের হয়ে যায় । ভালো ঘুম ওষুধের থেকেও ভালো কাজ করে।
আর দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমালে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।


ইনসমনিয়া হওয়ার কারণ
ইনসমনিয়ার মূল কারণ অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা। আর ফোনে অতিরিক্ত কথা বলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, পড়াশোনা ইত্যাদি কারণে ঘুমে দেরি হলে পরে সঠিক সময়ে ঘুম আসে না।
এছাড়াও আরও বেশ কিছু কারণ আছে যা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যেমন:
- মানসিক চাপ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ যেমন: চাকরি হারালে, প্রিয়জন মারা গেলে অথবা ডিভোর্স হলে যেমন চাপ হয় ইত্যাদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
- ডিপ্রেশন বা অবসাদ: ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্ত, টেনশন, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
- কিছু রোগের কারণে: উচ্চরক্ত চাপ এবং কিছু কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কে রাসায়নিক দ্রব্যের তারতম্য ঘটলে ইনসমনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- শারীরিক কিছু সমস্যায়: শারীরিক কিছু সমস্যা, যেমন- আর্থ্রাইটিস, বুক জ্বালা, মাথাব্যথা, দাঁতের সমস্যা, লিভার, ফুসফুস বা কিডনির সমস্যা, প্রোস্টেটের সমস্যা ইত্যাদির কারনে অনিদ্রা হতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহন: অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহন, যেমন- চা, কফি ইত্যাদি অতিরিক্ত উত্তেজক পদার্থ পান করলে ঘুমে ব্যাঘাত হবে।
- ধূমপান বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য: বর্তমানে ধূমপান বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন তরুণ সমাজের ইনসমনিয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
- নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ: প্রথম প্রথম হয়তো অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ঘুমের সমস্যা না হলেও পরবর্তীতে নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ইনসমনিয়ার সমস্যা বাড়তে পারে।
- কিছু ওষুধ সেবনের ফলে: কিছু কিছু ওষুধ সেবনের ফলে (যেমন: হাঁপানি রোগের ওষুধ সারাজীবন ধরে খেতে হয়) ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
- এলোমেলো কাজের সময়: কাজের শিফট যদি এলোমেলো হয় (যেমন- একদিন দিনে আবার অন্যদিন রাতে) তাহলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
- পরিবেশগত কারণে: আবার পরিবেশগত কারণে, যেমন- অতিরিক্ত কোলাহল, উচ্চস্বরে গান বাজানো, গাড়ির শব্দ ইত্যাদির কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।


ইনসমনিয়ার লক্ষণ
রাত্রে ঘুমের সমস্যার পাশাপাশি ইনসমনিয়ার যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে:
- সারাদিন ক্লান্তি লাগতে পারে
- দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব লেগে থাকতে পারে
- ঘুম ঘুম ভাব লেগে থাকলেও দিনের বেলা ঘুমানোর চেষ্টা করলে ঘুম আসতে চায় না
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকতে পারে
- ক্লান্তির কারণে দিনের বেলা কোন কাজে মনোযোগ দিতে কষ্ট হতে পারে


ইনসমনিয়ার চিকিৎসা বা ট্রিটমেণ্ট
আপনার যদি মনে হয় আপনার ইনসমনিয়া আছে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আপনার যদি মৃদু ইনসমনিয়া থাকে তাহলে তা ভালো ঘুমের অভ্যাসের সাহায্যে ভালো করে ফেলা সম্ভব। ইনসমনিয়ার কারণে যদি আপনার দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব আসে এবং ক্লান্তি লাগে, তাহলে ডাক্তার আপনাকে কিছুদিনের জন্য আপনাকে ঘুমের ওষুধ খেতে বলতে পারে তবে নিজে ঘুমের ওষুধ কিনে খাবেন না। এর ফলে খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বাঁ সাইড-ইফেক্ট থাকতে পারে এবং এগুলো সময়ের সাথে সাথে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
আর যদি আপনার ঘুমের সমস্যার মাত্রা অনেক বেশি হয়, তাহলে প্রথমে ইনসমনিয়া যে কারণে হচ্ছে সাধারণত তার চিকিৎসা করা হয়। এতে যদি ইনসমনিয়া ভালো না হয়, তাহলে আপনাকে কাউন্সেলিং (counselling) এবং বিহেভিওরাল থেরাপি (behavioral therapy) করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এটাতে যেসব কাজের মাধ্যমে ইনসমনিয়া বাড়ে সেই কাজগুলো আপনাকে বাদ দিতে সাহায্য করা হবে এবং যেসব ব্যবহারে ঘুম ভালো হবে সেগুলো সম্পর্কে শেখানো হবে।


ইনিসমনিয়া প্রতিরোধ করার উপায়
যদি আপনি ইনিসমনিয়া প্রতিরোধ করতে চান তাহলে এই কাজগুলো করে দেখতে পারেন:
- ঘুমের আগে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন: ঘুমের আগে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলোর থেকে যে আলো আসে তার কারণে ঘুম আসতে দেরি হয়।
- দিনের শেষাংশে ক্যাফেইন, অ্যালকোহল দূরে রাখুন: দিনের শেষে এসে ক্যাফেইন, নিকোটিন, অ্যালকোহল ইত্যাদি গ্রহন করা থেকে বিরত থাকুন। ক্যাফেইন এবং নিকোটিন এর কারণে ঘুম আসতে দেরি হতে পারে আর অ্যালকোহলের কারণে রাত্রে ঘুম ভালো না হতে পারে এবং মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
- নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম করুন তবে ঘুমের আগে ব্যায়াম করবেন না। কারণ ঘুমের আগে ব্যায়াম করলে ঘুম আসতে সমস্যা হবে। যদি রাতে ব্যায়াম করতে চান তাহলে ঘুমের কমপক্ষে তিন-চার ঘন্টা আগে ব্যায়াম করুন।
- রাতে কম খান: আগে পেট অতিরিক্ত ভর্তি করে খেলে ঘুম ভালো হবে না তাই রাত্রে ঘুমের আগে খুব বেশি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- বেডরুমকে আরামদায়ক করুন: আপনার বেডরুমকে আরামদায়ক করার চেষ্টা করুন। ঘরটা যেন অন্ধকার ও শব্দহীন এবং খুব বেশি গরম অথবা ঠান্ডা না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। যদি শব্দের সমস্যা থাকে তাহলে কানে ইয়ার প্লাগ (Ear Plug) দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
- নিজেকে রিলাক্স করুন: ঘুমের আগে রিলাক্স হওয়ার জন্য বই পড়তে, গান শুনতে অথবা গোসল করতে পারেন। আপনার যদি ঘুম না আসে তাহলে বিছানা থেকে উঠে বই পড়ুন বা শরীর/মন উত্তেজিত হয় না এমন কোনো কাজ করুন।
- কাজ নিয়ে চিন্তা কম করুন: শোয়ার পরে যদি পরের দিনের কাজ নিয়ে আপনার চিন্তা হয়, তাহলে একটা কাগজে সেগুলোর লিস্ট করুন।
- বিভিন্ন পজিশনে শুয়ে দেখুন: বিভিন্ন পজিশনে শুয়ে দেখুন কোনটাতে আপনি সবচেয়ে বেশি আরাম অনুভব করছেন।
লেখক: তানভীর