

এসেছে কোরবানির ঈদ। এ সময় লাল মাংস বা রেড মিট খাওয়া পড়ে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। গরুর মাংসের যেমন আছে কিছু উপকারিতা, তেমনি অতিরিক্ত বা বেশি মাত্রায় খেলে তা স্বাস্থের জন্য ঝুকির কারণও হতে পারে।
নিজেকে সুস্থ রাখতে গরুর মাংস কি পরিমাণে খাবেন, কীভাবে খাবেন ইত্যাদি আমাদের জেনে নেওয়া উচিৎ।
গরুর মাংসের পুষ্টিগুণঃ
পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, গরুর মাংসের মধ্যে রয়েছে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদানগুলো যেমন: প্রোটিন, ভিটামিনস, মিনারেলস বা খনিজ উপাদান। যে খনিজ উপাদানগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে: জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, আয়রন। আবার ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে: ভিটামিন বি২ বি৩, বি৬, এবং বি১২।
আর এই পুষ্টিকর উপাদানগুলোর উপকারিতা হচ্ছে :–
- ত্বক/চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
- অবসাদ/ মানসিক বিভ্রান্তি/ হতাশা দূর করে।
- পেশি, দাঁত ও হাড়ের গঠনে অবদান রাখে।
- শরীরের বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
- রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে।
- দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।
- অতিরিক্ত আলসেমি/ ক্লান্তি বা শরীরের অসাড়তা দূর করে কর্মোদ্যম রাখে।
- ডায়রিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
- খাবার থেকে দেহে শক্তি যোগান দিয়ে থাকে।
- স্মতিশক্তি বৃদ্ধি করে।


কার জন্য কতোটুকু প্রোটিন প্রয়োজনঃ
প্রোটিন পাওয়া যায় গরুর মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ইত্যাদি থেকে। সবচেয়ে বেশি প্রোটিন থাকে মগজে, এর পর কলিজায় আর তারপর মাংসে। প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদা মুলত নির্ভর করে মানুষের ওজনের ওপর।
পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, একজন মানুষের যদি আদর্শ ওজন হয় ৫০ কেজি এবং যদি তিনি সুস্থ থাকেন তাহলে প্রতিদিন তার প্রয়োজন হবে ৫০ গ্রামের মতো প্রোটিন। তবে তার যদি কিডনি জটিলতা কোন সমস্যা থাকে তাহলে তাকে প্রতিদিন ২৫ গ্রাম প্রোটিন খেতে হবে অর্থাৎ, স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তার চেয়ে অর্ধেক।
এছাড়াও, মেয়েদের মাসিক চলাকালীন অথবা গর্ভবতী কালীন অবস্থায় প্রোটিনের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, আদর্শ ওজন ৫০ কেজি হলে তারা খেতে পারবেন ১০০ গ্রাম পর্যন্ত প্রোটিন।
যাদের ওজন আদর্শ ওজনের থেকে কম তাদের প্রয়োজন বেশি বেশি প্রোটিন খাওয়া। তবে কারোরই প্রতিদিন ৭০ গ্রামের বেশি এবং সপ্তাহে ৫০০ গ্রামের বেশি প্রোটিন খাওয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে থাকে ২৬ গ্রাম প্রোটিন এবং ২ গ্রাম ফ্যাট। তার মানে কি আপনি প্রতিদিনের এই প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ২৭০ গ্রাম মাংস খাবেন? একদমই না, কারন দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা একটি খাবার নয় বরং অন্যান্য খাবার ও পানীয় দিয়ে আমরা পূরণ করে থাকি।


গরুর মাংস অতিরিক্ত খাওয়ার ঝুঁকিঃ
অতিরিক্ত গরুর মাংস শরীরের জন্য অনেক ক্ষতিকর হতে পারে বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদরা।
অতিরিক্ত গরুর মাংস খাওয়ার অপকারিতা হচ্ছে :–
- গরুর মাংসে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম রয়েছে যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। আর উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- গরুর মাংসে যে পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে সেটি বেশি বেড়ে গেলে হার্টের শিরায় জমে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিতে পারে। এতে হার্টে পর্যাপ্ত রক্ত চলাচল করতে পারে না, অক্সিজেনের অভাব হয়। যার ফলে হৃদরোগ আর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকগুণে বেড়ে যায়।
- যারা গরুর মাংস বেশি খান তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
- গরুর মাংস বেশি খেলে টাইপ-টু ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, আরথ্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
তাই, গরুর মাংস যদি খেতে হয় তার আগে বিশেষজ্ঞের থেকে জেনে নেওয়া উচিৎ আপনার কত পরিমান গরুর মাংস খাওয়া ঠিক হবে।


গরুর মাংস কতোটুকু খাওয়া নিরাপদঃ
কোরবানি ঈদের পর পর কয়েক দিন ধরে গরুর মাংস অনেক বেশি খাওয়া হয়ে থাকে। তাই এ সময় অনান্য প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন আর কখনোই প্রতিদিন একটানা মাংস খাওয়া যাবে না।
পুষ্টিবিদদের মতে, গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হচ্ছে সপ্তাহে দুই দিন আর মোট তিন থেকে পাঁচ বেলা। এই দুই দিনে আপনি মোট ১৫৪ গ্রাম গরুর মাংস খেতে পারবেন এবং সপ্তাহের ওই দুই দিন প্রতি বেলায় আপনার খাবার প্লেটে মাংসের পরিমাণ হবে ১৬ থেকে ২৬ গ্রাম।
সহজ করে বললে, ঘরে প্রতি বেলায় রান্না করা মাংস ২ থেকে ৩ টুকরার বেশি খাবেন না। কিন্তু যদি আপনি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাইপার-টেনশন বা কিডনির রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে চিকিৎসকের কাছ থেকে মাংস খাওয়ার পরিমাণ জেনে নিবেন।
পুষ্টিবিদদের মতে, সাধারণত সপ্তাহে এক থেকে দুই বেলা মাংস খেলে তেমন কোন ঝুঁকি নেই। তবে চিকিৎসকরা যদি মাংস খেতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেন, তাহলে খাবেন না।
বয়স, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ এবং শারীরিক পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে আমাদের প্রতিদিন প্রয়োজন হয় ১২০০-২০০০ ক্যালরি। আপনি যদি সপ্তাহের এক বেলায় চর্বি-ছাড়া ২৫ গ্রাম মাংস মানে মাঝারি আকারের ২ থেকে ৩ টুকরা মাংস খান, তাহলে সেটা থেকে আপনি পাবেন ৬২ ক্যালোরির মতো যা আপনাকে যোগান দেবে প্রতিদিনের চাহিদার মাত্র ৩%-৫% ক্যালোরি। তাই গরুর মাংস মানেই যে হাই ক্যালোরি, এই ধারণা সঠিক নয়।
যারা এতদিন ধারণা করতেন যে, গরুর মাংসে সবচেয়ে বেশি কোলেস্টেরল রয়েছে, তাদের মনে রাখতে হবে যে একটি মুরগির ডিমের কুসুমে থাকে ১৯০ মিলিগ্রাম ভালো কোলেস্টেরল যা কিনা চর্বি ছাড়া ২১০ গ্রাম গরুর মাংসের সমতুল্য। তাই গরুর মাংস মানেই অনেক বেশি কোলেস্টেরল, এই ধারণাটাও ভুল।


কিভাবে গরুর মাংস খেলে ঝুঁকি হ্রাস পাবেঃ
গরুর মাংস কতোটা নিরাপদ সেটা নির্ভর করবে আপনি সেটা কাটছেন কিভাবে এবং কিভাবে রান্না করছেন তার ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি হেলথ জার্নাল থেকে জানা যায়, গরুর শরীরের ২টি অংশে চর্বির পরিমাণ অনেক কম থাকে। একটি হচ্ছে: গরুর পেছনের রানের উপরে ফোলা অংশের মাংস যেটাকে “রাউন্ড” বলা হয় এবং অন্যটি হচ্ছে: পেছনের দিকের উপরের অংশের মাংস যেটাকে “সেরলয়েনঃ বলা হয়।
যেভাবে মাংস রান্না করা নিরাপদ, সেই উপায়গুলো হচ্ছে :–
- মাংসের বাইরে যে চর্বি লেগে থাকে, সেটা রান্নার আগে কেটে ফেলে দিলে সেটা কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনবে। তাই গরুর মাংস রান্নার আগে মাংসের গায়ে লেগে থাকা সব চর্বি কেটে ছাড়িয়ে নেওয়া উচিৎ।
- ছোট ছোট টুকরো করে মাংস কাটার চেষ্টা করুন। কারণ, মাংসের টুকরো যতো ছোট হবে ততোই চর্বির পরিমাণ কমে আসবে। এইজনই গরুর মাংস কিমা অথবা মাংস বাটায় চর্বি সবচেয়ে কম থাকে।
- মাংস কাটা শেষ হলে সেটা ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে আর কিছুক্ষণ পানিতে সেদ্ধ করতে হবে। এরপর দেখবেন পানিতে চর্বির স্তর উঠে আসছে। মাংস কিছুক্ষণ ফুটে ওঠার পর এই পুরো পানিটা ফেলে দেবেন। যদিও এতে মাংসে থাকা চর্বির পাশাপাশি ভিটামিনস ও মিনারেলসও বেরিয়ে যায়।
- সেদ্ধ মাংস কম তেল অর্থাৎ যতোটুকু না দিলেই না ততটুক তেল দিয়ে রান্না করুন। ঘি, মাখন, ডালডা এমন তেল না দেয়াই ভাল।
- মাংসে থাকা ফ্যাট আরও কমিয়ে আনতে ভিনেগার, লেবুর রস বা টক দই দিয়ে রান্না করতে পারেন।
- বেশি তেল বা মসলা দিয়ে কসিয়ে ভুনা করে গরুর মাংস রান্না না করাই উত্তম। এর চাইতে ভাল ঝোল ঝোল করে মাংস রান্না করা এবং খাবার সময় সেই ঝোল এড়িয়ে যাওয়া।
- গরুর মাংস আগুনে ঝলসে খেলে চর্বি অনেকটাই কমে যায়। গ্রিল, শিক কাবাব, জালি কাবাব ইত্যাদি পুড়িয়ে খাওয়ার কারণে ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
- গরুর মাংস যেন কম খাওয়া হয় সেজন্য মাংসের সাথে বিভিন্ন সবজি মেশাতে পারেন। যেমন: মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে ইত্যাদি।
- গরুর মাংসের কাবার বানানোর সময় কিমার সাথে যদি ডাল বা অন্যান্য খাদ্য উপাদান ব্যবহার করা হয়, তাহলে গরুর মাংস কম খাওয়া হয়।
- গরুর মাংস ফ্রিজে বা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা পরিবেশে রাখলে এর ওপর তেলের একটি আস্তর পড়ে আর সেটা ফেলে দিয়েও ফ্যাট অনেকটাই কমানো যায়।
লেখক: তানভীর